লিবিয়ার দেরনা শহরের আকাশ-বাতাস এখনো লাশের গন্ধে ভারী হয়ে আছে। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে মরদেহ উদ্ধার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন উদ্ধারকর্মীরা।সেখানে এখন পর্যন্ত ১১ হাজারের বেশি প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এখনো ১০ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের কোনো খোঁজ মিলছে না।
শহরের কাছেই অবস্থিত একটি সেতু বন্যার পানিতে পুরোপুরি ভেসে গেছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে মরদেহ পড়ে থাকায় তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে নিঃশ্বাস নেওয়াও এখন বেশ কষ্টসাধ্য। ঝাঁঝালো গন্ধে গা গুলিয়ে উঠবে আপনার, বিশেষ করে যদি কেউ বন্দরের দিকে যায় তবে বুঝতে পারবেন সেখানকার অবস্থা আরও খারাপ।
হাজার-হাজার মানুষ, ঘরবাড়ি পানির স্রোতে ভেসে গেছে। যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবনও পাল্টে গেছে। লোকজনের মধ্যে স্বজন হারানোর দুঃখ আর ক্ষোভ বাড়ছে। ফারিস গাসার নামের এক স্থানীয় বাসিন্দা তার পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়েছেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমাদেরকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছিল। তাদের বলা উচিত ছিল যে, ঝড় আসছে আর বাঁধটি নাজুক হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, কয়েকশ বছরের পুরনো ভবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা পুরোপুরি রাজনীতি। পশ্চিমে একটি সরকার, পূর্বে আরেকটি সরকার। এটাই আমাদের বড় সমস্যা। নিজের দশ মাস বয়সী কন্যা সন্তানকেও হারিয়েছেন ফারিস গাসার। সাগরে ভেসে যাওয়া মানুষকে উদ্ধার করতে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে উদ্ধারকারী দলগুলোকে। দেরনা শহরের দুটি বাঁধ ও চারটি সেতু ধসে পড়েছে।
রেড ক্রিসেন্ট বলছে, হাজার হাজার মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছে এবং মৃতের সংখ্যাও আরও বাড়তে পারে। উদ্ধার কর্মীরা ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে জীবিত মানুষের সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন। কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত দিয়ে জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থা আইওএম বলছে, শহরটিতে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অন্তত ৩০ হাজার মানুষ।
হাসপাতাল আর মর্গগুলো মৃতদেহে সয়লাব হয়ে পড়েছে। ২০১১ সালে মুয়াম্মার গাদ্দাফির মৃত্যুর পর থেকেই রাজনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে তেল সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়া। এর একটি সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃত এবং এর রাজধানী ত্রিপলি। আরেকটি সরকার পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
দেরনা শহরটি বেনগাজীর ২৫০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে। গাদ্দাফির পতনের পর এই শহরটি ছিল জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের একটি ঘাঁটি। পরে লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি বা এলএনএ তাদের বিতাড়িত করে। এলএনএ পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণকারী প্রশাসনের ঘনিষ্ঠ জেনারেল খালিফা হাফতারের প্রতি অনুগত। প্রভাবশালী এই জেনারেল বলেছেন বন্যার কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতি তারা নিরূপণ করছেন।
লিবিয়ার আল ওয়াসাত নিউজ ওয়েবসাইট বলছে, বহু বছর ধরে দেরনা শহরের রাস্তাঘাট পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার না হওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা এতো বেশি হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ত্রাণ সহায়তা পাঠাতে শুরু করেছে লিবিয়ায়। তবে দুর্গতদের দিন কাটছে শোকে, স্তব্ধতায়, নিদারুণ অভাব আর সংকটে।
দেরনা শহরে যে পরিমাণ ওষুধ এবং খাবার পানি প্রয়োজন স্থানীয় বাসিন্দারা তা পাচ্ছেন না। যারা বাড়ি-ঘর হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তাদের কাছে প্রয়োজনীয় সহায়তা এখনো পৌঁছায়নি। দেরনা শহর থেকে লোকজনকে পুরোপুরি সরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ঝড়ের তাণ্ডবে তিনটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানির তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে একেবারে সমুদ্রে নিয়ে ফেলেছে বহু বসতি। এর জেরেই বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পচা দেহের গন্ধ ও স্বজন হারানো পরিবারের লোকেদের আর্তনাদ মিশছে বাতাসে। গণকবর দেওয়া হচ্ছে মরদেহ। পরিচয়ের অপেক্ষায় হাসপাতালে পড়ে আছে বহু লাশ।
গত ৪ সেপ্টেম্বর গ্রিসের উপকূলে ভূমধ্যসাগরের ওপর তৈরি হয় ঘূর্ণিঝড় ‘ড্যানিয়েল’। এর ফলে ৫ ও ৬ সেপ্টেম্বর গ্রিসে রেকর্ড বৃষ্টিপাত ঘটে। গ্রিসের জাগোরা গ্রামের একটি অংশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, যা প্রায় ১৮ মাসের বৃষ্টিপাতের সমতুল্য।
লিবিয়ার জাতীয় আবহাওয়া কেন্দ্র জানিয়েছে, ১০ সেপ্টেম্বর তীব্রতর হয় ‘ড্যানিয়েল’। এর ফলে দেশের বিভিন্ন অংশে ১৫০ থেকে ২৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ বন্যা। সবচেয়ে বেশি হয়েছে লিবিয়ার আল-বায়দাতে। সেখানে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় ৪০০ মিলিমিটারেরও বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।
গত রোববার ভয়ঙ্কর শক্তি নিয়ে ‘ড্যানিয়েল’ আছড়ে পড়ে লিবিয়ার উপকূলে। ‘ড্যানিয়েল’-এর তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় আল-বায়দা, আল-মার্জ, তোবরুক, বাতাহ-র মতো বেশ কিছু শহর। তবে এদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দেরনা ও বেনগাজির। প্রবল বৃষ্টি ও বানের ফলে দেরনা শহর যেন এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে।
টিএইচ